যেসব কারণে চুক্তি বাতিল হতে পারে
ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ সরকার ‘চুক্তি আইন, ১৮৭২’ নামে একটি আইন তৈরি করেছিল, যা আজ পর্যন্ত আমরা অনুসরণ করছি।
একটি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর তা আইন দ্বারা বাতিল ঘোষিত হবে যদি তা আইনের কোনো একটি নির্দেশনা কিংবা বিধি লঙ্ঘন করে। চুক্তি আইন, ১৮৭২-এ কখন এবং কিভাবে একটি চুক্তি বাতিল হতে পারে তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই বাতিল চুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ঠিক এভাবে, যে চুক্তি আইনের মাধ্যমে কার্যকর করা যায় না, তাকেই ‘বাতিল চুক্তি’ বলে।
নিম্নে যেসব উপায়ে একটি চুক্তি বাতিল হতে পারে, তা উল্লেখ করা হলো
১।অযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি, চুক্তি আইন, ১৮৭২-এর ১১ ধারায় প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর বয়স), সুস্থ মস্তিষ্কের যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তিকে বৈধ বলে ঘোষণা দিচ্ছে। অর্থাৎ পাগল, অপ্রাপ্তবয়স্ক, দেউলিয়া ইত্যাদি ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করা হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
২।উভয়পক্ষের অজ্ঞাত ভুল ধারা ২০ অনুসারে, উভয়পক্ষের কারো কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুল কিংবা উভয়পক্ষের অজ্ঞাতসারে কোনো মৌলিক ভুল একটি চুক্তিকে বাতিল বলে গণ্য করতে পারে।
৩।অবৈধ প্রতিদান ও উদ্দেশ্য আইন সবসময় প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য দেখে। চুক্তি আইনের ২৩ ধারা অনুসারে, যদি কোনো চুক্তির প্রতিদান ও উদ্দেশ্য অবৈধ হয়, তবে সেই চুক্তিও অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে চুক্তির প্রতিদান ও উদ্দেশ্য অবৈধ বলে পরিগণিত হয়।
১। যদি কোনো অবৈধ কাজের চুক্তি হয় যা দেশের আইনে নিষিদ্ধ; যেমন খুন করার চুক্তি;
২। যদি চুক্তি অনুসারে তা সম্পাদন করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে দেশের প্রচলিত কোনো আইন ভঙ্গ করা হয়;
৩। যদি চুক্তিটি কাউকে প্রতারণার জন্য করা হয়;
৪। যদি চুক্তিটি অন্য কোনো ব্যক্তি বা সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকর হয়;
৫।যদি চুক্তিটিকে দুর্নীতিমূলক বা জনস্বার্থবিরোধী ও রাষ্ট্রনীতিবিরোধী বলে মনে করে।
৬।প্রতিদানহীন চুক্তি ইংরেজিতে একটি কথা আছে, No consideration, no contract অর্থাৎ প্রতিদানহীন চুক্তি কোনো চুক্তিই নয়। ধারা ২৫ অনুসারে প্রতিদান অর্থাৎ অর্থ বা অর্থমূল্যের কোনো কিছুর বিনিময়ে না হলে তা কখনই চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে না। অর্থের বিনিময় থাকতেই হবে_ হোক সেটি সামান্য বা আংশিক। তবে দান, উইল ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিদান না থাকলেও তা চুক্তি হিসেবে বিবেচিত।
৭।বিয়েতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী চুক্তি, কোনো সাবালক ব্যক্তি বিয়ে করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। তবে সাবালক কাউকে বিয়ে করতে চাইলে সে বিয়েতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কারো বিয়ের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করে যদি কোনো চুক্তি করা হয় তবে তা চুক্তি আইনের ধারা ২৬ অনুসারে আইনত বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন একজন মুসলমান একাধিক বিয়ে করতে পারে, সুতরাং তার দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়েতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না, করলে তা আইনত বাতিল বলে গণ্য হবে।
৭।আইনসঙ্গত পেশায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী চুক্তি, জীবনধারণের জন্য যে কেউই যে কোনো বৈধ পেশা অবলম্বন করতে পারে। চুক্তি আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী কারো বৈধ পেশা বা ব্যবসা-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে কেউ যদি কোনো চুক্তি করে, সে চুক্তি কিছু ব্যতিক্রম সাপেক্ষে বাতিল বলে গণ্য হবে।
৮।মামলায় প্রতিবন্ধকতা আরোপকারী চুক্তি, চুক্তি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো চুক্তি একপক্ষকে তার কোনো অধিকার আইনের মাধ্যমে কার্যকর করতে বাধার সৃষ্টি করে, সেই চুক্তি বাতিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
৯।অনিশ্চিত চুক্তি, যে চুক্তির অর্থ নিশ্চিত নয়, কিংবা নিশ্চিত করাও যায় না, সেই চুক্তি বাতিল চুক্তি হিসেবে গণ্য হবে ২৯ ধারানুযায়ী। মাঝিহীন নৌকার যেমন কোনো উদ্দেশ্য বা গন্তব্য নেই, ঠিক তেমনি লক্ষ্য বা অর্থহীন চুক্তি বাতিল বলে বিবেচিত।
১০।বাজি ধরার চুক্তি যে চুক্তির মাধ্যমে একপক্ষ অন্যপক্ষকে ভবিষ্যৎ কোনো অনিশ্চিত ঘটনা ঘটলে বা না ঘটলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে, তাকে বাজি ধরার চুক্তি বলে। বাজি ধরা হচ্ছে, একতরফা হারজিতের খেলা, যেখানে একপক্ষে কেবলই হেরে যায়, আর আরেক পক্ষ কেবল জিতেই যায়। কিন্তু বৈধ চুক্তিতে দুই পক্ষরই ন্যায়সঙ্গত দেয়া-পাওয়ার ব্যাপার থাকে এবং এখানে উভয়পক্ষই কিছু পায় ও কিছু দেয়। বাজি ধরার চুক্তি ভবিষ্যৎ ঘটনার ওপর নির্ভরশীল একতরফা হারজিতের ব্যাপার বলে তা চুক্তি আইনের ৩০ ধারা অনুসারে বাতিল।
১১।অসম্ভব কাজ সম্পাদনের চুক্তি, কেউ যদি অসম্ভব কোনো কাজ করে দেবে বলে চুক্তি করে, সেই চুক্তি ৫৬ ধারানুযায়ী বাতিল হবে। যেমন : আমি তোমাকে মঙ্গলগ্রহ থেকে একটি বাঘের ছানা এনে দেব, যা একটি অসম্ভব কাজ। সুতরাং এই মর্মে কেউ কোনো চুক্তি করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।