10 September, 2016
মানব পাচার প্রতিরোধ দমন আইন ২০১২( সনের ৩ নং আইন)
মানব পাচার প্রতিরোধ দমন মানব অপরাধের শিকার ব্যক্তিবর্গের সুরক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন
যেহেতু মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানব পাচার অপরাধের শিকার ব্যক্তিবর্গের সুরক্ষা ও অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে বিধান করা আবশ্যক; এবং
যেহেতু মানব পাচার সংক্রান্ত সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত আন্তঃদেশীয় অপরাধসমূহ প্রতিরোধ ও দমনকল্পে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;
সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইলঃ
প্রথম অধ্যায় প্রারম্ভিক সংক্ষিপ্ত শিরোনাম প্রবর্তন
১। (১) এই আইন মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ নামে অভিহিত হইবে।
(২) ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
সংজ্ঞা ২। বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোন কিছু না থাকিলে, এই আইনে—
(১) ‘‘আশ্রয় কেন্দ্র’’ অর্থ জেলখানা ব্যতীত এমন প্রতিষ্ঠান যাহা, যেই নামেই অভিহিত হউক না কেন, মানব পাচারের শিকার বা মানব পাচার হইতে উদ্ধারকৃত ব্যক্তিবর্গের গ্রহণ, আশ্রয় এবং পুনর্বাসনকল্পে প্রতিষ্ঠিত;
(২) ‘‘আশ্রয় দেওয়া’’ বা ‘‘লুকাইয়া রাখা’’ (harbouring)অর্থ কোন ব্যক্তিকে তাহার দেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে বিক্রয় বা পাচারের উদ্দেশ্যে লুকাইয়া রাখা, আশ্রয় দেওয়া বা অন্য কোনভাবে সহায়তা করা এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (১৮৬০ সনের ৪৫ নং আইন) এর ধারা ৫২ক এ যেই অর্থে ‘‘Harbour” অভিধাটি ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহাও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(৩) ‘‘ঋণ-দাসত্ব (debt-bondage)’’ অর্থ কোন ব্যক্তির সেইরূপ অবস্থান যাহার কারণে উক্ত ব্যক্তি কোন ঋণের জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়গ্রস্ত হইলে অথবা বেআইনিভাবে তাহাকে ঋণ-দায়গ্রস্ত বলিয়া দাবী করা হইলে উক্ত ব্যক্তিকে উক্ত ঋণের জামানতস্বরূপ নিজের ব্যক্তিগত সেবা বা শ্রম প্রদান করিতে হয়, কিন্তু উক্ত সেবা বা শ্রমের মূল্য ঋণ পরিশোধ হিসাবে গণ্য হয়না অথবা উক্ত সেবা বা শ্রম প্রদানের কাল অসীম হয়;
(৪) ‘‘জবরদস্তিমূলক শ্রম বা সেবা’’ অর্থ কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, অধিকার, সম্পত্তি বা সুনামের ক্ষয় বা ক্ষতি করিবার হুমকি প্রদর্শন করিয়া তাহার নিকট হইতে যে কাজ বা সেবা গ্রহণ করা হয়;
(৫) ‘‘ট্রাইব্যুনাল’’ অর্থ এই আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল অথবা মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসাবে নিযুক্ত (assigned) বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোন ট্রাইব্যুনাল;
(৬) ‘‘দাসত্ব’’ অর্থ কোন ব্যক্তির অবস্থান বা মর্যাদার (status) এমন পর্যায়ে অবনমন যাহার ফলে উক্ত ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক সম্পত্তির মত নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হয় এবং উক্ত ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত কোন ঋণ বা সম্পাদিত কোন চুক্তির কারণে উদ্ভুত কোনো শর্ত বা অবস্থাও (condition) উহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(৭) ‘‘দূতাবাস’’ অর্থ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কোন মিশন যা দূতাবাস, হাইকমিশন, উপ- হাইকমিশন, বা সহকারী হাইকমিশন এবং উক্ত দেশসমূহে অবস্থিত কনস্যুলেট- জেনারেল এবং কনস্যুলেট এবং ভিসা অফিসসমূহও উহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(৮) ‘‘পতিতাবৃত্তি’’ অর্থ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অথবা অর্থ বা সুবিধা (kind) লেনদেন করিয়া কোন ব্যক্তির যৌন শোষণ বা নিপীড়ন;
(৯) ‘‘পতিতালয়’’ অর্থ পতিতাবৃত্তি পরিচালনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কোন বাড়ি, স্থান বা স্থাপনা;
(১০) ‘‘মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি’’ বা ‘‘ভিকটিম’’ অর্থ এই আইনের অধীন সংঘটিত মানব পাচার অপরাধের শিকার কোন ব্যক্তি এবং উক্ত ব্যক্তির আইনগত অভিভাবক বা উত্তরাধিকারীও (legal heirs) ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(১১) ‘‘প্রতারণা’’ (fraud) অর্থ ঘটনা বা আইন লইয়া ইচ্ছাকৃত বা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কথা বা আচরণ বা লিখিত কোন চুক্তি বা দলিল দ্বারা অন্যকে প্রতারিত (to defraud) বা প্রলুদ্ধ (to induce)বা ভুল পথে পরিচালিত করা এবং প্রতারণাকারী ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তির অভিপ্রায়কে কেন্দ্র করিয়া সংঘটিত প্রবঞ্চনা (deception) এবং চুক্তি আইন, ১৮৭২ (১৮৭২ সনের ৯নং আইন) এর ধারা ১৭ এ যেই অর্থে ‘Fraud ’অভিধাটি ব্যবহৃত হইয়াছে তাহাও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(১২) ‘‘বলপ্রয়োগ’’ অর্থ শক্তি প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপ প্রয়োগ এবং ইহার সহিত কোন প্রকার ক্ষতিসাধন করিবার বা দৈহিকভাবে আটক রাখিবার হুমকি প্রদর্শন, নির্যাতন বা কোন ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক, দাপ্তরিক বা আইনগত অবস্থানকে অন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাজে লাগাইবার হুমকি প্রদান বা মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
(১৩) ‘‘ব্যক্তি’’ অর্থ স্বাভাবিক ব্যক্তিসহ (natural person)যে কোন কোম্পানী, অংশীদারী কারবার বা ফার্ম বা একাধিক ব্যক্তির সমিতি বা সংঘ তাহা নিবন্ধিত হউক বা না হউক;
(১৪) ‘‘শিশু’’ অর্থ আঠার বৎসর বয়স পূর্ণ করে নাই এমন কোন ব্যক্তি;
(১৫) ‘‘শোষণ’’ বা ‘‘নিপীড়ন’’ (exploitation) অর্থ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাহার সম্মতিক্রমে বা বিনা সম্মতিতে কৃত নিম্নলিখিত কার্যসমূহ, তবে কেবল এইসব বিষয়েই ইহার অর্থ সীমিত হইবেনাঃ—
(ক) পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে শোষণ বা নিপীড়ন;
(খ) কোন ব্যক্তিকে পতিতাবৃত্তি অথবা পর্ণোগ্রাফি উৎপাদন বা বিতরণে নিয়োজিত করিয়া মুনাফা ভোগ;
(গ) জবরদস্তিমূলক শ্রম বা সেবা আদায়;
(ঘ) ঋণ-দাসত্ব (debt-bondage), দাসত্ব বা সার্ভিচিউড্(servitude) , দাসত্বরূপ কর্মকাণ্ড, বা গৃহস্থালীতে সার্ভিচিউড্;
(ঙ) প্রতারণামূলক বিবাহের মাধ্যমে শোষণ বা নিপীড়ন;
(চ) কোন ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বিনোদন ব্যবসায় ব্যবহার;
(ছ) কোন ব্যক্তিকে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা; এবং
(জ) ব্যবসা করিবার উদ্দেশ্যে অপরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহানী বা কাউকে বিকলাঙ্গ করা;
(১৬) ‘‘সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ’’ অর্থ জাতীয়তা এবং অবস্থান নির্বিশেষে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কাঠামোবদ্ধ কোন সংগঠন যাহা নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সক্রিয় এবং যাহার সদস্যরা এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে একত্রে কাজ করে;
(১৭) ‘‘সম্মতি’’ অর্থ কোন ব্যক্তির স্বাধীন এবং স্বজ্ঞানে প্রদত্ত মতামত যাহা তাহার বয়স, লিঙ্গ এবং আর্থ- সামাজিক পশ্চাদপদতার কারণে সৃষ্ট তাহার দুর্বল অবস্থান কর্তৃক প্রভাবিত হইবেনা;
(১৮) ‘‘সরকারি কর্মকর্তা’’ (public servant/official) অর্থ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ ( ১৮৬০ সনের ৪৫ নং আইন) এর ধারা ২১ এ বর্ণিত কোনো জনসেবক বা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২ এর সংজ্ঞানুসারে রাষ্ট্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি যিনি এই আইনের অধীন কোন আইনি দায়িত্ব পালন বা বহন করেন;
(১৯) ‘‘সার্ভিচিউট’’ (servitude) অর্থ কাজ বা সেবা প্রদান করিবার বাধ্যবাধকতা অথবা কাজ বা সেবার জবরদস্তিমূলক শর্তাবলী যাহা হইতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিষ্কৃতি মেলেনা বা যাহা তিনি ঠেকাইতে বা পরিবর্তন করিতে পারেন না।
মানব পাচার
৩। (১) ‘‘মানব পাচার’’ অর্থ কোন ব্যক্তিকে
(ক) ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করিয়া; বা
(খ) প্রতারণা করিয়া বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (vulnerability) কাজে লাগাইয়া; বা
(গ) অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (kind) লেনদেন-পূর্বক উক্ত ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রহিয়াছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করিয়া;
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের (exploitation) উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেওয়া (harbour)।
(২) যেইক্ষেত্রে কোন শিশু পাচারের শিকার হয়, সেইক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) হইতে (গ) তে বর্ণিত মানব পাচার অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমসমূহ (means)অনুসৃত হইয়াছে কিনা তাহা বিবেচিত হইবেনা।
ব্যাখ্যা।— এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে প্রতারণার মাধ্যমে, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা ‘সার্ভিচিউড’ (servitude) বা ধারা-২ এর উপ-ধারা (১৫) এ বর্ণিত কোনো শোষণ বা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির শিকার হইতে পারে মর্মে জানা থাকা সত্বেও অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকুরীর উদ্দেশ্যে গমন, অভিবাসন বা বহির্গমন করিতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কর্ম উপ-ধারা (১) এ সংজ্ঞায়িত ‘‘মানব পাচার’’ এর অন্তর্ভুক্ত হইবে।
আইনের প্রাধান্য এবং ফৌজদারী কার্যবিধি , ইত্যাদির প্রযোজ্যতা
৪। (১) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর হইবেঃ
তবে শর্ত থাকে যে, প্রচলিত অন্য কোন আইনে ভিকটিম এবং সাক্ষীর সুরক্ষা বিষয়ক শ্রেয় মানদণ্ডের বিধান থাকিলে সেই সকল বিধানসমূহ এই আইনের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া সাপেক্ষে প্রযোজ্য হইবে।
(২) এই আইনের অধীন মামলা বা অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, অপরাধসমূহের বিচার এবং বিচার সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে এই আইনে কোন বিধান না থাকিলে, ক্ষেত্রমত, ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ (১৮৯৮ সনের ৫ নং আইন) এবং সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (১৮৭২ সনের ১ নং আইন) এর বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে।
(৩) এই আইনের অধীন অপরাধ ও দণ্ডের দায়-দায়িত্বের বিষয়ে দণ্ডবিধি, ১৮৬০, (১৮৬০ সনের ৪৫ নং আইন) এর তৃতীয় অধ্যায়ের বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে।
(৪) এই আইনের সংঘটিত অপরাধসমূহ এক্সট্রাডিশন আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের ৫৮ নং আইন) এর ধারা ২(১)(ক) তে সংজ্ঞায়িত ‘extradition’ অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে।
(৫) এই আইন অভিবাসন (emigration) ও বহিরাগমন (immigration) বিষয়ক অন্যান্য প্রচলিত আইনের পরিপূরক হইবে এবং তাহাদের ব্যত্যয়ে ব্যবহৃত হইবেনা।
এই আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগ
৫। (১) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাহিরে অথবা বাংলাদেশের কোন জাহাজ বা বিমানে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশী কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে এই আইনের আওতাধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করিলে এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর হইবে।
(২) যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহির হইতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অথবা বাংলাদেশের অভ্যন্তর হইতে বাংলাদেশের বাহিরে এই আইনের আওতাধীন কোন অপরাধ সংঘটন করে তাহা হইলে উক্ত অপরাধ ও তাহা সংঘটনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত ব্যক্তি ও অপরাধের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর হইবে।