15 October, 2016
পারিবারিক আইনে সন্তানের অভিভাবকত্ব
প্রশ্ন: সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক কে ?
উত্তর: পারিবারিক আইনের আওতায় প্রায় সকল আইনেই পিতা সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক। সাধারণত সকল ধর্মেই পিতা-মাতার বিচ্ছেদ অথবা যে কোন একজন বা দুইজনের মৃত্যুর পরই অভিভাবকত্বের প্রশ্নটি আসে।
প্রশ্ন: সব ধর্মে অভিভাবকত্ব আইন কি আলাদা আলাদা ?
উত্তর: হ্যাঁ, প্রত্যেক ধর্মেই আলাদা আলাদা অভিভাবকত্ব আইন আছে।
প্রশ্ন: মুসলিম পারিবারিক আইনে কি ধরণের অভিভাবকত্বের কথা বলা আছে?
উত্তর: মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তানের ৩ ধরনের অভিভাবকত্বের কথা বলা আছে যথা: সন্তানের অভিভাবকত্ব, সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকত্ব, সন্তানের বিয়ের অভিভাবকত্ব।
প্রশ্ন: সন্তানের অভিভাবকত্বে মা কি ধরনের অধিকার পান ?
উত্তর: মুসলিম আইনে শিশু সন্তানের দেখাশোনার বিষয়ে (জিম্মাদারের ক্ষেত্রে) সবচেয়ে বড় অধিকারী হলেন মা। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তানের জিম্মাদার হয়ে থাকেন, কিন্তু কখনো অভিভাবক হতে পারেন না।
প্রশ্ন: নির্দিষ্ট সময় মানে কত দিনের জন্য ?
উত্তর: এই সময়কাল হলো ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর, মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ো:সন্ধিকাল পর্যন্ত।
প্রশ্ন: তবে ছেলে-মেয়ে নির্ধারিত বয়স পার করলে কি মা আর জিম্মাদার থাকতে পারবেন না ?
উত্তর: নাবালকের কল্যাণেই নির্দিষ্ট বয়সের পরেও মায়ের জিম্মাদারিত্বে সন্তান থাকতে পারে। যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের নিকট থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ঐ বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন।
প্রশ্ন: মা কি শুধু জিম্মাদার ?
উত্তর: মুসলিম আইনে মা সন্তানের আইনগত অভিভাবক নন। কেবলমাত্র জিম্মাদার।
প্রশ্ন: মায়ের অবর্তমানে কারা শিশুর জিম্মাদার হতে পারেন ?
উত্তর: মাতার অবর্তমানে যারা শিশুর জিম্মাদার হতে পারেন:
১। মায়ের মা যত উপরের দিকে হোক (নানী, নানীর মা)
২। পিতার মা যত উপরের দিকে হোক (দাদী, দাদীর মা)
৩। পূর্ণ বোন (মা,বাবা একই)
৪। বৈপিত্রেয় বোন (মা একই কিন্তু বাবা ভিন্ন)
৫। আপন বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক)
৬। বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক)
৭। পূর্ণ খালা (যত উপরের দিকে হোক)
৮। বৈপিত্রেয় খালা (যত উপরের দিকে হোক)
৯। পূর্ণ ফুফু (যত উপরের দিকে হোক)
বি:দ্র: উপরে উল্লেখিত আত্মীয়গণ কেবলমাত্র উপরের ক্রমানুসারে একজনের অবর্তমানে বা অযোগ্যতার কারণে অন্যজন জিম্মাদারিত্বের অধিকারী হবেন।
প্রশ্ন: মা এবং নারীদের অবর্তমানে কারা জিম্মাদার হবেন?
উত্তর: মা অথবা অন্যান্য নারী আত্মীয়দের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদার হতে পারেন যারা তারা হলেন:
১। বাবা
২। বাবার বাবা (যত উপরের দিকে হোক)
৩। আপন ভাই
৪। রক্তের সম্পর্কের ভাই
৫। আপন ভাইয়ের ছেলে
৬। রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে
৭। বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে
৮। বাবার রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে।
বি:দ্র=একজন পুরুষ আত্মীয় একজন নাবালিকার জিম্মাদার কেবলমাত্র তখনই হতে পারবেন যখন তিনি ঐ নাবালিকার নিষিদ্ধস্তরের আত্মীয় হন।
প্রশ্ন: নাবালক শিশুর সম্পত্তির ক্ষেত্রে অভিভাবক কে হবেন ?
উত্তর:মুসলিম আইনে কোন নাবালক শিশুর সম্পত্তির তিন ধরনের অভিভাবক হতে পারে:
১। আইনগত অভিভাবক
২। আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক
৩। কার্যত অভিভাবক
প্রশ্ন: আইনগত অভিভাবক বলতে কি বুঝায়?
উত্তর: আইনগত অভিভাবকরা হলেন-
(১) বাবা
(২) বাবার ইচ্ছাপত্রে (উইল) উল্লেখিত ব্যক্তি
(৩) বাবার বাবা (দাদা)
(৪) বাবার বাবার ইচ্ছাপত্রে (উইল) উল্লেখিত ব্যক্তি
বি:দ্র:=উপরে উল্লেখিত আইনগত অভিভাবকগণ নিম্নলিখিত কারণে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে পারেন:
১।উক্ত সন্তানের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য তার অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে পারেন।
২।নাবালকের ভরণপোষণ, উইলের দাবী, ঋণ, ভূমিকর পরিশোধ ইত্যাদির জন্য একজন আইনগত অভিভাবক নিচের এক বা একাধিক কারণে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন।
৩। ক্রেতা দ্বিগুন দাম দিতে প্রস্তুত,
৪। স্থাবর সম্পত্তিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,
৫। সম্পত্তিটি রক্ষণাবেক্ষণে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
প্রশ্ন: আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক বলতে কি বুঝায় ?
উত্তর: যখন আইনগত অভিভাবক থাকেন না তখন আদালত নাবালকের সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত অভিভাবকরাই হলেন আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক। তবে এই অভিভাবক আদালতের অনুমতি ছাড়া কোন কারণেই সম্পত্তির কোন অংশ বিক্রি, বন্ধক, দান, বিনিময় বা অন্য কোন প্রকার হস্তান্তর করতে পারবে না।
প্রশ্ন: কার্যত অভিভাবকের কাজ কি ?
উত্তর: নাবালককে রক্ষার জন্য আইনগত অভিভাবক বা আদালত নিযুক্ত অভিভাবক না হয়েও যে কেউ নাবালকের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন। বাস্তবে এরকমভাবে যিনি অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন তিনিই হলেন কার্যত অভিভাবক। তবে তিনি কোন অবস্থাতেই সম্পত্তির স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার হস্তান্তর করতে পারবেন না।
প্রশ্ন: সন্তান বড় হলে বিয়ে দিতে হবে এক্ষেত্রে অভিভাবক কে হবে ?
উত্তর: ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ২ ধারা অনুযায়ী ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮ হতে হবে এবং এটি বিয়ের একটি শর্ত। ফলে সন্তানের বিয়ের অভিভাবকত্ব বিধানটি বর্তমানে প্রযোজ্য নয়।
প্রশ্ন আচ্ছা, হিন্দু পারিবারিক আইনেও অভিভাবকত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে কি ?
উত্তর: হ্যাঁ, হিন্দু আইনেও অভিভাবকত্বের কথা বলা হয়েছে। এই আইনে ৩ ধরনের অভিভাবক স্বীকৃত।
প্রশ্ন: এই তিন প্রকার অভিভাবক কারা ?
উত্তর: এই তিন প্রকার অভিভাবক হচ্ছে-
১। স্বাভাবিক অভিভাবক;
১।বাবা কর্তৃক উইল দ্বারা নিযুক্ত অভিভাবক;
৩। গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ অনুযায়ী আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক।
এছাড়া ‘কার্যত অভিভাবক’ হিসেবেও অভিভাবক দেখা যায়।
প্রশ্ন: বাবার অবর্তমানে হিন্দু আইন অনুসারে কে সন্তানের অভিভাবক হবেন ?
উত্তর: বাবার অবর্তমানে মা নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির আইনগত অভিভাবক কিন্তু বাবা যদি উইল করে অন্য কোন ব্যক্তিকে নাবালকের অভিভাবক নিযুক্ত করেন তাহলে মা অপেক্ষা সেই ব্যক্তির দাবী গণ্য হবে। বাবা মা কেউ না থাকলে প্রয়োজনে আদালত নাবালকের নিকবর্তী আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজনকে নাবালকের অভিভাবক নিযুক্ত করতে পারেন।
প্রশ্ন: খ্রিস্টান ধর্মে অভিভাবকত্ব কিভাবে নির্ধারিত হয় ?
উত্তর: খ্রিস্টান ধর্মে সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণ হয় দুইভাবে- বিয়ে বিচ্ছেদ বা জুডিশিয়াল সেপারেশনের মাধ্যমে এবং গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট এর মাধ্যমে।
প্রশ্ন: অভিভাবকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে কি বিবেচনা করা হয় ?
উত্তর: সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারনের ক্ষেত্রে আদালতের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে সন্তানের কল্যাণ। অর্থাৎ বাবা অথবা মা কার কাছে থাকলে সন্তানের লালনপালন বেশি ভাল হবে। সুতরাং সন্তানের ভাল থাকাই হচ্ছে সর্বোচ্চ বিবেচনার বিষয়।
এছাড়া আরো দুটি বিষয় সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসবে।
প্রশ্ন: সে দুটি বিষয় কি ?
উত্তর: সন্তানের ধর্ম। খ্রিস্টান পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক পিতা। ফলে সন্তান মায়ের কাছে থাকলেও পিতার ধর্ম বিশ্বাসেই তাকে বড় করতে হবে এমনকি মায়ের ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন হলেও। মা যদি সন্তানকে পিতার ধর্ম বিশ্বাসে বড় করতে ব্যর্থ হন তাহলে তিনি অভিভাবকত্ব হারাতে পারেন।
মার অর্থনৈতিক অবস্থা যদি ভাল না হয় তাহলে সন্তানের লালনপালন, ভরণপোষণ, প্রতিপালন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিতে ব্যাঘাত ঘটবে বলে যদি আদালত মনে করেন তাহলে আদালতও সন্তানের পিতামহকেই গুরুত্ব দিবেন। তবে এক্ষেত্রে পিতামহের আর্থিক অবস্থা মায়ের চাইতে স্বচ্ছল হতে হবে।
প্রশ্ন: আর অন্য ধর্মে ?
উত্তর: বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছাড়া বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন আদিবাসী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী রয়েছে। বৌদ্ধ এবং আদিবাসীদের মধ্যে একটি বড় অংশের অভিভাবকত্ব আইন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ন্যায় হয়ে থাকে। এদের আর একটি অংশ অভিভাবকত্ব খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মতে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
প্রশ্ন: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কি আলাদা কোন নিয়ম নাই?
উত্তর: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কোন কোন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রথা ও রীতি অনুযায়ী অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করে থাকে। এদের অভিভাবকত্ব নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হলে গোষ্ঠী প্রধানরাই তার সমাধান করেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাসিয়া ও গারো সম্প্রদায় মাতৃতান্ত্রিক এবং অন্য সকল সম্প্রদায় পুরুষতান্ত্রিক । ফলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীই কেবলমাত্র অভিভাবক। উল্লেখ্য, গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য।
নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি কত সালে নিসিদ্ধ করা হয়?
জানতে চাই ?